Friday, August 28, 2009

মালোপাড়া : বামপন্থী আন্দোলনের এক মাইলস্টোন

মালোপাড়া : বামপন্থী আন্দোলনের এক মাইলস্টোন
জীবন মৈত্র
১৯৮৩ সালের ৫ই জুলাই। আর পাঁচটা গ্রামের মতো মালোপাড়াতেও ভোর হচ্ছে। মালোপাড়া রতুয়া-১ ব্লকের একটি অখ্যাত গ্রাম। ১৯৮৩ সালের ৫ই জুলাইয়ের আগে মালদহের বাইরের মানুষতো দূরের কথা — মালদহের অধিকাংশ মানুষের কাছে অজানা ছিলো এই গ্রামের নাম। কিন্তু ঐদিন ভোরেই রাতের অন্ধকার কাটার আগেই ঐ এলাকার মানুষ প্রত্যক্ষ করলো নারকীয় হত্যাকাণ্ডের ঘটনা। যা মুহূর্তে পরিণত করলো মালোপাড়াকে শুধু জেলা বা রাজ্যে নয় — গোটা দেশেই। কংগ্রেসী গুণ্ডাবাহিনীর হাতে প্রকাশ্য দিবালোকে নৃশংসভাবে খুন হলেন ১৩জন সি পি আই (এ‌ম) কর্মী। আহত হলেন অনেকে।
৫ই জুলাই ভোর সাড়ে পাঁচটা নাগাদ হাজার খানেক কংগ্রেস(আই) সমর্থক হিংস্র হায়নার মতো গ্রামটির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এই দলে ছিলো এলাকার প্রচুর কুখ্যাত সমাজবিরোধী। হাতে ছিলো বোমা, বন্দুক, হাঁসুয়া, বল্লম, কেরোসিন ও পেট্রোল ভর্তি টিন। এমনকি তেল ছেটানোর কাজে ব্যবহার করার জন্য পিচকারিও। প্রথমেই ঐসব সশস্ত্র মানুষ আক্রমণ করলো সি পি আই (এম)-র জেলা কমিটির সদস্য ও জেলা পরিষদের নির্বাচিত সদস্য আব্দুল বারি ও তাঁর দাদা সামশুল হুদার বাড়ি। বারি সাহেব বাড়িতে ছিলেন না তাই প্রাণে বাঁচেন তিনি। যদিও আক্রমণের প্রধান লক্ষ্যই ছিলেন তিনি। বারি সাহেব ও তাঁর দাদার বাড়ি থেকে পরিবারের লোকেরা আতঙ্কে পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নেয় গ্রামেরই আব্দুল হক ও নজমুল হকের বাড়িতে। ঐ সময় আরও কংগ্রেসী গুণ্ডারা এসে যোগ দেয় ঐ দলের সাথে। সশস্ত্র গুণ্ডারা প্রথমে বারি ও তাঁর দাদার বাড়িকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে আক্রমণ করে নজমুল হক ও আব্দুল হকের বাড়ি। ঐ বাড়িতে তখন অনেক সি পি আই (এ‌ম) কর্মী ও সমর্থক নিয়ে আছেন। বাড়ি দু’টি ঘিরে রেখে প্রথমে কেরোসিন ও পেট্রোল ছিটিয়ে জতুগৃহে পরিণত করে আগুন ধরিয়ে দেয় — সকলকে একসাথে পুড়িয়ে মারার উদ্দেশ্যে। প্রথমে মেয়েরা আগুনের তাপ সহ্য করতে না পেরে বে‍রিয়ে আসার চেষ্টা করলে তারা আক্রান্ত হন, রক্তাক্ত হন। পরে পুরুষরা বেরিয়ে আসার চেষ্টা করলে ঐ হিংস্র কংগ্রেসীরা তাদের উপর চড়াও হয়। কয়েক মিনিটের মধ্যে ১১জন লাশ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। নিহতদের মধ্যে ১৪-১৫ বছরের ৩জন ছাত্র যেমন ছিলো তেমনি ৬০ বছরের বৃদ্ধ কৃষকও ছিলেন। একজন খুন হন গুলিতে। বাকিরা সবাই হাঁসুয়া, বল্লম, ছোরার আঘাতে। মৃতদের কারোর গলা কাটা, কারোর মাথায় বল্লম গাঁথা, একজনের মুখে ছোরা ঢুকিয়ে গালের ভিতর দিয়ে কান পর্যন্ত টেনে দিয়েছে। পরে হয়েছে বোমাচার্জ। খুনের ধরন দেখে পরিষ্কার কোনো অপরিকল্পিত ঘটনা এটি নয়। পরিকল্পিতভাবেই ঘটনা ঘটানো হয়েছে। আক্রমণকারীরা যে পেশাদারী অপরাধী, খুনী তার খুনের ধরন দেখেই বোঝা যায়। শুধু এই দুই বাড়ি নয়, ঘণ্টা কয়েক ধরে ঐ দুষ্কৃতীরা গ্রামের সি পি আই (এ‌ম) কর্মী-সমর্থকদের বাড়ি বেছে বেছে আক্রমণ করে। পরিবারের লোকদের মারধর করে, আহত, রক্তাক্ত করে। যার পরিণতি মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৩-তে। আহত অসংখ্য মানুষ। মৃতদের মধ্যে আব্দুল বারির দুই ছেলে, তার দাদা ও তার দুই ছেলে রয়েছে। রয়েছে গ্রামের অন্যান্য সি পি আই (এম) কর্মীরা। আব্দুল বারির মেয়েকেও প্রথমে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না — পরে আহত, রক্তাক্ত অবস্থায় তাকে পাওয়া যায় মাঠের মধ্য থেকে।
সেদিন এই ঘটনার পর সর্বত্র ধিক্কার জানানো হলেও কংগ্রেসীরা কিন্তু বিচলিত হয়নি। তারা একটি প্রচারপত্র প্রকাশ করে খুনীদের প্রকাশ্যে অভিনন্দন জানায়। কংগ্রেস নেতা গনিখান ঘটনার আগে অনুষ্ঠিত পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে ও পরে প্রকাশ্যে জনসভায় উত্তেজক ভাষণ দিয়ে বেরিয়েছেন। এই ঘটনা সেই উত্তেজক ভাষণের ফলশ্রুতি বলেই সেই সি পি আই (এ‌ম) অভিহিত করেছিলো। এমনকি গনিখান ঘটনার ৪দিন পর গ্রামে গিয়ে ঘটনাকে সি পি আই (এম)-র বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান হিসাবে উল্লেখ করেছিলেন। এই বীভৎস নারকীয় হত্যাকাণ্ড কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিলো না। রাজ্যজুড়ে খুন-আক্রমণের মধ্য দিয়ে সন্ত্রাস সৃষ্টির বৃহত্তর পরিকল্পনার অন্যতম অঙ্গ ছিলো। এর কিছুদিন আগেই ৩১শে মে রাজ্যে অনুষ্ঠিত হয়েছিলো দ্বিতীয় পঞ্চায়েত নির্বাচন। সেই নির্বাচনে মালদহ জেলা পরিষদে সি পি আই (এম) ২৯টি আসনে এবং কংগ্রেস ২৮টি আসনে জয়ী হয়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে কংগ্রেসীরা। তৎকালীন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী গনিখান চৌধুরী সর্বত্র সি পি আই (এম)-বিরোধী হিংস্র ও উত্তেজক বক্তৃতা দিয়ে কংগ্রেসী দুষ্কৃতীদের খেপিয়ে তোলার চেষ্টা করেন। ঘটনার কয়েকদিন আগে মালোপাড়ার নিকটবর্তী বাটনা হাই মাদ্রাসায় গনিখান সি পি আই (এম)-র বিরুদ্ধে হিংসাত্মক বক্তৃতা দেন। তিনি বলেছিলেন,‘একজন কংগ্রেসকে দশজন সি পি আই (এম) কাটতে।’ এই সময় তিনি বিভিন্ন বক্তৃতায় জেলা পরিষদ দখলের জেহাদ ঘোষণা করেন।
উল্লেখ্য, এই মালোপাড়াতেই থাকেন জেলা পরিষদে নির্বাচিত সি পি আই (এম) নেতা আব্দুল বারি। সি পি আই সদস্যদের খুন করলে অনায়াসে জেলা পরিষদ দখল করা যায়। কংগ্রেসী খুনেবাহিনীর লক্ষ্য ছিলো তাই আব্দুল বারি। কিন্তু সেদিন বারি বাড়িতে ছিলেন না। বারিকে না পেয়ে ক্ষিপ্ত খুনীরা ঝাঁপিয়ে পড়ে অন্যদের ওপর।
৩১শে আগস্ট, ১৯৫৯ সালে কংগ্রেসী পুলিসের হাতে নিহত হয়েছিলেন ৮০জন কৃষক। এরপর ৫০ বছর পেরিয়ে গেছে। কিন্তু বামপন্থী কর্মীদের উপর আক্রমণ বন্ধ হয়নি। ২০০৯ সালে ঐ আক্রমণ আরও তীব্র হয়েছে। এখনও প্রতিদিন সাম্রাজ্যবাদী মদতপুষ্ট অতিবাম ও দক্ষিণপন্থী শক্তির আক্রমণে মারা যাচ্ছেন অসংখ্য বামপন্থী কর্মী। শহীদ স্মরণে ৫০বছর পদার্পণের প্রাক মুহূর্তে অন্যান্য শহীদদের সাথে মালোপাড়ার ঐ ১৩জন শহীদকে স্মরণ করাও জরুরী। বাংলার মানুষের গণ-আন্দোলনের ইতিহাসে ঐ ঘটনা একটা মাইলস্টোন হিসাবে বিবেচিত হবে। বামপন্থী আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে যাঁরা শহীদ হয়েছেন আমরা তাঁদের জানাই লাল সেলাম।